'কৃত্তিবাসী রামায়ণ' সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা
পৃথিবীর চারটি মহাকাব্যের মধ্যে একটি হল 'রামায়ণ' , যেটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। রামায়ণের প্রভাব সুদূর প্রসারী। বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণ সাত কান্ডে বিভক্ত। বিভিন্ন সাহিত্যিক বিভিন্ন ভাবে 'রামায়ণ ' অনুবাদ করেছেন।
কবি কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণ
বাঙালি জীবনের উপযোগী করে
পরিবেশন করেন। ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে
শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ' কীর্তিবাস রামায়ণ ' বলে প্রকাশিত হয়। মহাভারতের কথা তথা রামের কথা
গ্ৰামে-গঞ্জে প্রচার করার জন্য তিনি গানের আকারে তা লিপিবদ্ধ করেন। কৃত্তিবাস তার রামায়ণ কে 'লাচাড়ি ' ছন্দের পুরাণ বলেছেন।
'লাচাড়ি ' হল ছন্দ, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশন করা।
কৃত্তিবাসের ' শ্রীরাম পাঁচালি ' কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা বিভিন্ন পুথি পাঠ করলে বোঝা যায়। তাঁর আত্মবিবরনী থেকে জানা যায় বারো বছর বয়সে শুক্রবারে ' বড় গঙ্গা ' অর্থাৎ পদ্মা
পার হয়ে গুরুর গৃহে শিক্ষালাভ
করতে গিয়েছিলেন ---
' এগারো নিবড়ে যখন বারোতে প্রবেশ।
হেন কালে পড়িতে গেলাম উত্তর দেশ।।
বৃহস্পতিবার ঊষা পোহালেই শুক্রবার।
পাঠের নিমিত্ত গেলাম বড় গঙ্গা পার।। ,
বিভিন্ন পুথিতে এই প্রসঙ্গ যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে তার দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি--
১) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭১৭ নং
পুথিতে ---
'ছোটরা বন্দো বড়রা বন্দো বড় গঙ্গার পার।
যথা তথা করিয়া বেড়ান বিদ্যার উদ্ধার।।,
নলিনী ভট্টশালী কতৃক প্রকাশিত পুঁথিতে -
' বারান্তর উত্তরে গেলাম বড়গঙ্গা পার ।
তথায় করিনু আমি বিদ্যার উদ্ধার।। '
কবি কৃত্তিবাস ' শ্রীরাম পাঁচালী ' জনসাধারণের শিক্ষার উদ্দেশ্যে রাজার আদেশে রচনা করেছেন।
কৃত্তিবাস মূলত বাল্মীকি রামায়ণ কে অনুসরণ করেছেন । তাছাড়াও
তিনি অন্যান্য গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে কৃত্তিবাসের
স্বীকারোক্তি হল ---
১) 'নাহিক এসব কথা বাল্মীকি রচনে।বিস্তারিচ লিখিত অদ্ভুত রামায়ণে।। '
২) 'এসব গাহিল গীত জৈমিনি ভারতে।
সম্প্রতি যে গাই তাহা বাল্মীকির মতে।।'
কবি সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাই দেখা যায় কবি অধ্যাত্ম রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, পদ্মপুরাণ, মার্কন্ডেয়পুরান, স্কন্দপুরাণ, দেবী ভাগবত , জৈমিনি ভারত, কালিকাপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ অনুসরণ করেছেন।
কৃত্তিবাসের কবিত্ব
কৃত্তিবাস তাঁর স্বভাবসুলভ দৃষ্টিতে বাঙালি গ্ৰাম্য জীবনের ছবিকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি পুরাণকে গ্রহণ ও গ্রাস করে বাঙালির স্বভাবসুলভ দৃষ্টি অনুযায়ী নতুন পথের অনুসন্ধিৎসুযাত্রী হয়েছেন। গল্পরসের মধ্যে যেমন এনেছেন নাটকীয়তা তেমনই আবার করুনরসের কাহিনীতে হাস্যরসকে স্বাভাবিক ভাবে প্রবাহিত করেছেন। করুনরসের বর্ণনায় কৃত্তিবাস অসাধারণ প্রতিভার কবি। এই
করুনরস রামের বনবাস থেকে সীতার পাতাল প্রবেশ পর্যন্ত পাঠককে অশ্রুসিক্ত করেছে --
'সীতা সীতা বলি রাম ডাকেন বিস্তর।
সীতা নাহি রামের তরে কে দিবে উত্তর।।
একদৃষ্টে চাহেন রাম সোনার সীতার মুখ।
উত্তর না পাইয়া রামের অধিক বাড়ে দুখ।।,
করুনরস ছাড়াও কবি হাস্যরসকে
সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা
পাঠককে স্বাভাবিক ভাবেই আকর্ষণ করে। যেমন ----
'দশমুখ মেলিয়া রাবণ রাজা হাসে।
কেতকী কুসুম যেন ফোটে ভাদ্রমাসে।।,
কৃত্তিবাস চরিত্র গুলি বাঙালির
মতো গড়ে তুলেছেন, তাই মহাকাব্যের চরিত্র গুলির মতো
ওজস্বীতা নেই। তিনি রামকে গড়ে তুলেছেন এক প্রেমের দেবতা হিসেবে। যেখানে বাল্মীকি রামায়ণে
রামকে এক ক্ষত্রিয় বীর পুরুষ হিসাবে দেখানো আছে। আর অন্য দিকে কৃত্তিবাসের রাম সীতার দুঃখে কেঁদে ফেলেন। লক্ষনকে গড়ে তুলেছেন এক বাঙালি ভাই
হিসাবে। আর সীতা এক বাঙালি
গৃহবধূ , যে তার স্বামীকে না দেখতে পেয়ে প্রায়ই কাঁদেন। সব
মিলিয়ে বাঙালি দাদা, ভাই ও বৌদির সুন্দর ছবি বাঙালির
মতোই ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালি
জীবনের হাসি- কান্না, সুখ- দুখ
কৃত্তিবাসী রামায়ণে লুকিয়ে আছে।
No comments:
Post a Comment