মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি
নারায়ণ দেবের কবি প্রতিভা
মনসা মঙ্গল কাব্যের কবি বল্লভ,
সুকবি বল্লভ বা শ্রীহট্টীয় কবি নামে যিনি অধিক পরিচিত তিনি হলেন নারায়ণ দেব। মনসা মঙ্গল কাব্যের প্রাচীন কবিদের পরেই তাঁর স্থান। অসমীয়া ভাষায় লেখা নারায়ণ দেবের
পুঁথির খোঁজ মিলেছে। তিনি তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে জানিয়েছেন----
' নারায়ণ দেবে কয়েকটি জন্ম মগধ।
মিশ্র পন্ডিত নহে ভট্ট বিশারদ।।
অতিশুদ্ধ জন্ম মোর কায়স্থের ঘর।
মৌদগল্য গোত্র মোর গাঁই গুণাকর।।
পিতামহ উদ্ধব নরসিংহ পিতা।
মাতামহ প্রভাকর রুক্মিণী মোর মাতা।। পূর্বপুরুষ মোর অতি শুদ্ধ মতি।
রাঢ় ত্যাজিয়া মোর বোর গ্ৰামেগঞ্জে বসতি।। '
এখান থেকে বোঝা যায় দেব উপাধি প্রাপ্ত নারায়ণ দেব মগধ থেকে
আগত। পিতামহ উদ্ধব দেব, মাতামহ প্রভাকর। তাঁর বৃদ্ধ পিতামহ উদ্ধবরাম
দেব রাঢ়দেশ থেকে পূর্ববঙ্গের
ময়মনসিংহ জেলার বোর গ্ৰামেগঞ্জে এসে বসবাস করতে থাকেন। কবির পিতার নাম নরসিংহ এবং মাতার নাম
রুক্মিনী দেবী । কবির গোত্র হল মৌদগল্য।
নারায়ণ দেবের কাব্যের নাম
'পদ্মপুরাণ '। কাব্যটির রচনাকাল নিয়ে সংশয় আছে। কাব্যের মুদ্রিত পুঁথি কোথাও পুর্ণাঙ্গ নয়। সেই জন্য
কাব্যের কবি প্রতিভা আলোচনা করা
একটু সমস্যা রয়েছে। কাব্যের বংশতালিকা অনুযায়ী কবি পঞ্চদশ শতাব্দীর মানুষ ছিলেন। কবি ছিলেন
সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত। কাব্যে লৌকিক কাহিনীর থেকে পৌরাণিক কাহিনী বেশি। পৌরাণিক দেবদেবীর প্রতি কবির দৃষ্টি ছিল ব্যাপক। তিনি দেব খন্ডের কাহিনী গ্ৰহন করেছেন মহাভারত, শৈবপুরান, কুমারসম্ভব প্রভৃতি থেকে। তুর্কি আক্রমণে বিদ্ধস্থ
বাঙালির টুকরো টুকরো ঘটনা তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। এক কথায়
তাঁর কাব্যে যুগ চেতনার স্বার্থক প্রতিফলন ঘটেছে।
কাহিনী গ্ৰন্থনে নারায়ণ দেবের বেশ কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে। তবে চরিত্র চিত্রায়নে কাহিনী গত দুর্বলতাকে অনেকটা পূর্ণ করতে পেরেছেন তিনি। তাঁর কাব্যে পান্ডিত্যের সঙ্গে সরলতা ও স্বাভাবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। মানব-মানবীর চরিত্রের ব
স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য রুপায়নে তিনি অদ্ভুত শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এইসব দিক লক্ষ্য রেখে ড. ভূদেব
চৌধুরী তাঁকে "আদিম মানবতার "কবি
বলে চিহ্নিত করেছেন। কবির কলমে
চাঁদ সওদাগরের পৌরুষকার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক
সমুন্নতি আমাদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট
করে। চাঁদের মৃত পুত্রদের ও সম্পদ
নিয়ে বেহুলা ফিরে এসে মনসা পূজার
জন্য শ্বশুরকে অনুরোধ করলে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে চাঁদ উত্তর দিয়েছে ,
"কি করিব পুত্রে মোর কি করিব ধনে
না পুজিব পদ্মাবতী দৃঢ় করিনু মনে"
নিজের ব্যক্তিত্বে একান্ত শ্রদ্ধাশীল "স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরাধর্ম ভয়াবহ" এই মনোবৃত্তির উন্নতমনা চাঁদ সওদাগর এর চরিত্র একমাত্র নারায়ান দেবই অঙ্কন করেছেন। শুধু চাঁদ সওদাগরই নয় বেহুলা
চরিত্র চিত্রাঙ্কনে তিনি অসম্ভব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বেহুলা চরিত্র টিকে তিনি কমলে জঠরে অনবদ্য, একদিকে দৈবাহত জীবনের দুর্দশায় বিপদগ্রস্ত অন্যদিকে প্রতিকূল দৈবের সঙ্গে সংগ্রামে অটল। বেহুলার পতিভক্তির নিষ্ঠা তারুণ্যের মধ্যে উজ্বল হয়ে উঠেছে। সাথী
হারার গোপন ব্যাথায় তার অন্তর মাথিত
সেই সঙ্গে সংকল্পেও অবিচল থেকেছে।
মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে ভাসতে ভাসতে তার
মর্মস্পর্শী বিলাপ কবির কলমে চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে।
" জাগো প্রভু কালিন্দি নিশাচরে
ঘুচাও কপট নিদ্রা ভাসি সাগরে "
নারায়ান দেবের বেহুলা শান্ত স্নিগ্ধ
কূলবধূ হয়েও নির্মম দৈবা শক্তির বিরুদ্ধে
সংগ্রাম শীল বিলাম্বনা নারী। স্বনাকা
চরিত্র টিকেও কবি শোক বিহ্বল পুত্রহারা
চিরকালের বেদনাবৃদ্ধ জননী রূপে গড়ে তুলেছেন। এককথায় স্বনকা চরিত্র করুন রসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে । এ প্রসঙ্গে ড.
আশুতোষ ভট্টাচার্য্য বলেছেন , " মনসা
মঙ্গল কাব্য করুন রসের আকর। এই করুন রসের স্বাভাবিক বর্ণনায় নারায়ান
দেবের সমকক্ষ কেউ নাই।" এছাড়াও
অপ্রধান চরিত্র গুলির ক্ষেত্রে কবি রূঢ় রুক্ষ বাস্তবতার পরিচয় রেখেছেন । যেমন
বেহুলার যাত্রা পথে জমদানের স্ত্রী , ধনা মনা , গঙ্গাই সাধু প্রভৃতি খল ও দুষ্ট চরিত্র গুলি কবির কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কবি নারায়ান দেব মনসা মঙ্গল কাব্যের
কাহিনী লিখতে গিয়ে প্রাচীন গ্রাম বাংলার
মানুষের সুখ , দুঃখ, হাসি, কান্না ভরা
জীবনের বাস্তবোচিত দিক তুলে ধরেছেন।
তাই তার কাব্যে ঐতিহাসিক উপাদান প্রচুর। তারকার বন্ধন, লখিন্দরের বাসগৃহ র হাস্য কৌতুক, চাঁদের বানিজ্য যাত্রা , নানা দেশ ও নদীর বিবরণ , নানা স্বর্গের বিবরণ , পল্লীর মানুষের সুখ দুঃখ সামাজিক রীতনীতিতে নারায়ান দেবের
কাব্য পরিপূর্ণ। বক্রোক্তি , কৌতুক রস
তির্যকতা সৃষ্টিতে কবির দক্ষতা অপরিসীম। তাঁর কাব্যে অশ্লীলতা মাঝে মাঝে দেখা যায়, তবে তৎকালীন যুগ
পরিবেশ ও জীবন চেতনার বিচারে দোষা
বহ মনে হয় না।
পরিশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, চরিত্র রুপায়ানে , কাহিনী
গ্রন্থনে , জীবন রসের বৈচিত্রে নারায়ান
দেবের পদ্মাপুরান উৎকর্ষ কাব্যের সঙ্গে
তুলনীয় । তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সপ্তদশ
শতাব্দীর কবি ক্ষেমানন্দ ব্যাস বাল্মীকির
সঙ্গে সশ্রদ্ধ চিত্তে তাকে স্মরণ করেছেন...
" ব্যাস বাল্মীক কবি নারায়ান তত্ত্ব জানি
তোমাকে সেবিয়া হইলা কবি " ******************************
কাহিনী গ্ৰন্থনে নারায়ণ দেবের বেশ কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে। তবে চরিত্র চিত্রায়নে কাহিনী গত দুর্বলতাকে অনেকটা পূর্ণ করতে পেরেছেন তিনি। তাঁর কাব্যে পান্ডিত্যের সঙ্গে সরলতা ও স্বাভাবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। মানব-মানবীর চরিত্রের ব
স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য রুপায়নে তিনি অদ্ভুত শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এইসব দিক লক্ষ্য রেখে ড. ভূদেব
চৌধুরী তাঁকে "আদিম মানবতার "কবি
বলে চিহ্নিত করেছেন। কবির কলমে
চাঁদ সওদাগরের পৌরুষকার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক
সমুন্নতি আমাদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট
করে। চাঁদের মৃত পুত্রদের ও সম্পদ
নিয়ে বেহুলা ফিরে এসে মনসা পূজার
জন্য শ্বশুরকে অনুরোধ করলে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে চাঁদ উত্তর দিয়েছে ,
"কি করিব পুত্রে মোর কি করিব ধনে
না পুজিব পদ্মাবতী দৃঢ় করিনু মনে"
নিজের ব্যক্তিত্বে একান্ত শ্রদ্ধাশীল "স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরাধর্ম ভয়াবহ" এই মনোবৃত্তির উন্নতমনা চাঁদ সওদাগর এর চরিত্র একমাত্র নারায়ান দেবই অঙ্কন করেছেন। শুধু চাঁদ সওদাগরই নয় বেহুলা
চরিত্র চিত্রাঙ্কনে তিনি অসম্ভব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বেহুলা চরিত্র টিকে তিনি কমলে জঠরে অনবদ্য, একদিকে দৈবাহত জীবনের দুর্দশায় বিপদগ্রস্ত অন্যদিকে প্রতিকূল দৈবের সঙ্গে সংগ্রামে অটল। বেহুলার পতিভক্তির নিষ্ঠা তারুণ্যের মধ্যে উজ্বল হয়ে উঠেছে। সাথী
হারার গোপন ব্যাথায় তার অন্তর মাথিত
সেই সঙ্গে সংকল্পেও অবিচল থেকেছে।
মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে ভাসতে ভাসতে তার
মর্মস্পর্শী বিলাপ কবির কলমে চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে।
" জাগো প্রভু কালিন্দি নিশাচরে
ঘুচাও কপট নিদ্রা ভাসি সাগরে "
নারায়ান দেবের বেহুলা শান্ত স্নিগ্ধ
কূলবধূ হয়েও নির্মম দৈবা শক্তির বিরুদ্ধে
সংগ্রাম শীল বিলাম্বনা নারী। স্বনাকা
চরিত্র টিকেও কবি শোক বিহ্বল পুত্রহারা
চিরকালের বেদনাবৃদ্ধ জননী রূপে গড়ে তুলেছেন। এককথায় স্বনকা চরিত্র করুন রসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে । এ প্রসঙ্গে ড.
আশুতোষ ভট্টাচার্য্য বলেছেন , " মনসা
মঙ্গল কাব্য করুন রসের আকর। এই করুন রসের স্বাভাবিক বর্ণনায় নারায়ান
দেবের সমকক্ষ কেউ নাই।" এছাড়াও
অপ্রধান চরিত্র গুলির ক্ষেত্রে কবি রূঢ় রুক্ষ বাস্তবতার পরিচয় রেখেছেন । যেমন
বেহুলার যাত্রা পথে জমদানের স্ত্রী , ধনা মনা , গঙ্গাই সাধু প্রভৃতি খল ও দুষ্ট চরিত্র গুলি কবির কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কবি নারায়ান দেব মনসা মঙ্গল কাব্যের
কাহিনী লিখতে গিয়ে প্রাচীন গ্রাম বাংলার
মানুষের সুখ , দুঃখ, হাসি, কান্না ভরা
জীবনের বাস্তবোচিত দিক তুলে ধরেছেন।
তাই তার কাব্যে ঐতিহাসিক উপাদান প্রচুর। তারকার বন্ধন, লখিন্দরের বাসগৃহ র হাস্য কৌতুক, চাঁদের বানিজ্য যাত্রা , নানা দেশ ও নদীর বিবরণ , নানা স্বর্গের বিবরণ , পল্লীর মানুষের সুখ দুঃখ সামাজিক রীতনীতিতে নারায়ান দেবের
কাব্য পরিপূর্ণ। বক্রোক্তি , কৌতুক রস
তির্যকতা সৃষ্টিতে কবির দক্ষতা অপরিসীম। তাঁর কাব্যে অশ্লীলতা মাঝে মাঝে দেখা যায়, তবে তৎকালীন যুগ
পরিবেশ ও জীবন চেতনার বিচারে দোষা
বহ মনে হয় না।
পরিশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, চরিত্র রুপায়ানে , কাহিনী
গ্রন্থনে , জীবন রসের বৈচিত্রে নারায়ান
দেবের পদ্মাপুরান উৎকর্ষ কাব্যের সঙ্গে
তুলনীয় । তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সপ্তদশ
শতাব্দীর কবি ক্ষেমানন্দ ব্যাস বাল্মীকির
সঙ্গে সশ্রদ্ধ চিত্তে তাকে স্মরণ করেছেন...
" ব্যাস বাল্মীক কবি নারায়ান তত্ত্ব জানি
তোমাকে সেবিয়া হইলা কবি " ******************************
No comments:
Post a Comment