বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের অনুবাদ মূলক এবং মৌলিক গ্রন্থ গুলির নাম।

      বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর

   বীরসিংহের সিংহ শিশু বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা গদ্যের জনক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী তিনি। নিম্নে তার সাহিত্যে অবদানের দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।             বিদ্যাসাগর সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য ছিল নিছক জনকল্যাণ সাহিত্য রচনা নয়। ১৮৪৭-১৮৬৫ যে পর্বটিকে তত্ত্ববোধিনী পর্ব বলা হয় ,তা এক অর্থে বিদ্যাসাগর পর্ব । তিনি যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সময়টি ছিল  'Age of reason'এবং  'Rights of man'এর যুগ অর্থাৎ যুক্তি দ্বারা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উন্মেষ কাল। বিদ্যাসাগর  ছিলেন এই কালের সার্থক পুরোহিত।তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশের ছেলে, তাই সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেছিলেন অল্প বয়সে সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করে অধ্যাপকদের দ্বারা বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। তার রচনাবলী কে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। (১)অনুবাদ মূলক। (২)মৌলিক রচনা সমূহ। তার অনুবাদ মূলক রচনা গুলির মধ্যে আছে হিন্দি 'বৈতাল পচ্চীসী' এর অনুবাদ 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম' নাটকের অনুবাদ 'শকুন্তলা'। ভবভূতির
উত্তর চরিত এবং বাল্মীকি রামায়ণের উত্তর কান্ডের আখ্যানের অনুসরনে 'সীতার বনবাস'।শেক্সপিয়রের 'Comedy of Errors'এর অনুবাদে ভ্রান্তিবিলাস, এছাড়াও মার্শম্যানের 'History of bengal'এর কয়েকটি অধ্যায় অবলম্বনে 'বাংলার ইতিহাস' ইত্যাদি রচনা করেন।
তার মৌলিক রচনা গুলি হলো 'প্রভাবতী সম্ভাষণ', 'বিদ্যাসাগরচরিত' ,'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রস্তাব'। এছাড়াও তার সমাজ সংস্কার মূলক রচনা মধ্যে আছে ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, 'বহুবিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিষয়ক প্রস্তাব'। তাঁর লঘু রচনার মধ্যে আছে 'অতি অল্প হইল', 'আবার অতি অল্প হইল','ব্রজবিলাস' ও 'রত্নপরীক্ষা' এগুলি তার কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য ছদ্মনামে রচিত। তাঁর কয়েকটি শিক্ষামূলক রচনার মধ্যে আছে 'বর্ণপরিচয়' ও 'সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা'।
বিদ্যাসাগর সংস্কারান্ধ ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন না ,তাই সংস্কৃতের অশেষ জ্ঞান থাকলেও ইংরেজি গদ্যের প্রসাদগুণ,
প্রাঞ্জলতা ,পরিমাণগত অস্বাভাবিকতা বিদ্যাসাগরকে মুগ্ধ করেছিল। সংস্কৃত ও ইংরেজি উভয় ধারার সম্মেলনে বাংলা গদ্যের সাধু ভাষা তে তিনি এক নিজস্ব স্টাইল আনলেন। 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' তে বাংলা গদ্যের এই আদি সাধু ভাষার প্রথম সাহিত্যিক প্রকাশ । এবং 'শকুন্তলা'য় শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। শকুন্তলার ভাষা যেমন লালিত্য পূর্ণ তেমনি শিল্পশ্রী মন্ডিত। 'সীতার বনবাস' এর মধ্যবর্তী কালেও তিনি মহাভারতের উপক্রমণিকা অনুবাদ করেন। সেখানেও তিনি গুরুগম্ভীর ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার গদ্য কতখানি সরল আধুনিক হয়ে উঠেছিল তা 'অতি অল্প হইল', 'আবার অতি অল্প হইল', 'ব্রজবিলাস' বিদ্যাসাগরের এই গ্রন্থ গুলি দেখলেই বোঝা যাবে।একটি মানুষের রচনায় বাংলা সাধু ভাষার আদিরূপ থেকে আধুনিক রূপ দেখতে পায়। বিরতি ও যতি চিহ্ন দ্বারা শাসিত ও সংশোধিত করে বাংলা গদ্য বোধের ভাষাকে রসের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। কমা সেমিকোলন এর ব্যবহার যথার্থ অধিকারের ঢঙে প্রথম করতে পেরেছিলেন বিদ্যাসাগর। বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী এই জন্যই যে,বাংলা সাধু গদ্যের কাঠামো কি রকম হওয়া উচিত এই নিয়ে তিনি অনেক পরীক্ষা করেছিলেন । এবং গদ্যের সম্ভাবনা নিয়েও পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি বাংলা গদ্য কে দিয়েছেন স্বাতন্ত্র ও অভিজাত্য।

মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি নারায়ণ দেবের কবি প্রতিভা।

   মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি
       নারায়ণ দেবের কবি প্রতিভা

         মনসা মঙ্গল কাব্যের কবি বল্লভ, 
সুকবি বল্লভ বা শ্রীহট্টীয় কবি নামে যিনি অধিক পরিচিত তিনি হলেন নারায়ণ দেব। মনসা মঙ্গল কাব্যের প্রাচীন কবিদের পরেই তাঁর স্থান। অসমীয়া ভাষায় লেখা নারায়ণ দেবের
পুঁথির খোঁজ মিলেছে। তিনি তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে জানিয়েছেন----
' নারায়ণ দেবে কয়েকটি জন্ম মগধ। 
     মিশ্র পন্ডিত নহে ভট্ট বিশারদ।। 
  অতিশুদ্ধ জন্ম মোর কায়স্থের ঘর। 
মৌদগল্য গোত্র মোর গাঁই গুণাকর।। 
     পিতামহ উদ্ধব নরসিংহ পিতা। 
মাতামহ প্রভাকর রুক্মিণী মোর মাতা।।     পূর্বপুরুষ মোর অতি শুদ্ধ মতি। 
রাঢ় ত্যাজিয়া মোর বোর  গ্ৰামেগঞ্জে বসতি।।  '
    এখান থেকে বোঝা যায় দেব উপাধি প্রাপ্ত নারায়ণ দেব মগধ থেকে 
আগত। পিতামহ উদ্ধব দেব, মাতামহ প্রভাকর। তাঁর বৃদ্ধ পিতামহ উদ্ধবরাম
দেব রাঢ়দেশ  থেকে পূর্ববঙ্গের 
ময়মনসিংহ জেলার বোর গ্ৰামেগঞ্জে এসে বসবাস করতে থাকেন। কবির পিতার নাম নরসিংহ এবং মাতার নাম
রুক্মিনী দেবী । কবির গোত্র হল মৌদগল্য। 
            নারায়ণ দেবের কাব্যের নাম 
 'পদ্মপুরাণ '। কাব্যটির রচনাকাল নিয়ে সংশয় আছে। কাব্যের মুদ্রিত পুঁথি কোথাও পুর্ণাঙ্গ নয়। সেই জন্য
কাব্যের কবি প্রতিভা আলোচনা করা 
একটু সমস্যা রয়েছে। কাব্যের বংশতালিকা অনুযায়ী কবি পঞ্চদশ শতাব্দীর মানুষ ছিলেন। কবি ছিলেন 
সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত। কাব্যে লৌকিক কাহিনীর থেকে পৌরাণিক কাহিনী বেশি। পৌরাণিক দেবদেবীর প্রতি কবির দৃষ্টি ছিল ব্যাপক। তিনি দেব খন্ডের কাহিনী গ্ৰহন করেছেন মহাভারত, শৈবপুরান, কুমারসম্ভব প্রভৃতি থেকে। তুর্কি আক্রমণে বিদ্ধস্থ
বাঙালির টুকরো টুকরো ঘটনা তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। এক কথায়
তাঁর কাব্যে যুগ চেতনার স্বার্থক প্রতিফলন ঘটেছে। 
        কাহিনী গ্ৰন্থনে নারায়ণ দেবের বেশ কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে। তবে চরিত্র চিত্রায়নে কাহিনী গত দুর্বলতাকে অনেকটা পূর্ণ করতে পেরেছেন তিনি। তাঁর কাব্যে পান্ডিত্যের সঙ্গে সরলতা ও স্বাভাবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। মানব-মানবীর চরিত্রের ব
স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য রুপায়নে তিনি অদ্ভুত শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এইসব দিক লক্ষ্য রেখে ড. ভূদেব
চৌধুরী তাঁকে "আদিম মানবতার "কবি
বলে চিহ্নিত করেছেন। কবির কলমে
চাঁদ সওদাগরের পৌরুষকার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক 
সমুন্নতি আমাদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট
করে। চাঁদের মৃত পুত্রদের ও সম্পদ
নিয়ে বেহুলা ফিরে এসে মনসা পূজার
জন্য শ্বশুরকে অনুরোধ করলে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে চাঁদ উত্তর দিয়েছে ,
 "কি করিব পুত্রে মোর কি করিব ধনে
না পুজিব পদ্মাবতী দৃঢ় করিনু মনে"
নিজের ব্যক্তিত্বে একান্ত শ্রদ্ধাশীল  "স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরাধর্ম ভয়াবহ" এই মনোবৃত্তির উন্নতমনা চাঁদ সওদাগর এর চরিত্র একমাত্র নারায়ান দেবই অঙ্কন করেছেন। শুধু চাঁদ সওদাগরই নয় বেহুলা
চরিত্র চিত্রাঙ্কনে তিনি অসম্ভব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বেহুলা চরিত্র টিকে  তিনি কমলে জঠরে অনবদ্য, একদিকে দৈবাহত জীবনের দুর্দশায় বিপদগ্রস্ত অন্যদিকে প্রতিকূল দৈবের সঙ্গে সংগ্রামে অটল। বেহুলার পতিভক্তির নিষ্ঠা তারুণ্যের মধ্যে উজ্বল হয়ে উঠেছে। সাথী
হারার গোপন ব্যাথায় তার অন্তর মাথিত
সেই সঙ্গে সংকল্পেও অবিচল  থেকেছে।
মৃত স্বামীর দেহ  নিয়ে ভাসতে ভাসতে তার
মর্মস্পর্শী বিলাপ কবির কলমে চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে।
 " জাগো প্রভু কালিন্দি নিশাচরে
   ঘুচাও কপট নিদ্রা ভাসি সাগরে "
       নারায়ান দেবের বেহুলা শান্ত স্নিগ্ধ
কূলবধূ  হয়েও নির্মম দৈবা শক্তির বিরুদ্ধে
সংগ্রাম শীল  বিলাম্বনা নারী। স্বনাকা
চরিত্র টিকেও কবি শোক বিহ্বল পুত্রহারা
চিরকালের বেদনাবৃদ্ধ জননী  রূপে গড়ে তুলেছেন। এককথায় স্বনকা চরিত্র করুন রসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে । এ প্রসঙ্গে ড.
আশুতোষ ভট্টাচার্য্য বলেছেন , " মনসা
মঙ্গল কাব্য করুন রসের আকর। এই করুন রসের স্বাভাবিক বর্ণনায় নারায়ান
দেবের সমকক্ষ কেউ নাই।" এছাড়াও
অপ্রধান চরিত্র গুলির ক্ষেত্রে কবি রূঢ় রুক্ষ বাস্তবতার পরিচয় রেখেছেন । যেমন
বেহুলার যাত্রা পথে জমদানের স্ত্রী , ধনা মনা , গঙ্গাই সাধু প্রভৃতি খল ও দুষ্ট চরিত্র গুলি কবির কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
   কবি নারায়ান দেব মনসা মঙ্গল কাব্যের
কাহিনী লিখতে গিয়ে প্রাচীন গ্রাম বাংলার
মানুষের সুখ , দুঃখ, হাসি, কান্না ভরা
জীবনের বাস্তবোচিত দিক তুলে ধরেছেন।
তাই তার কাব্যে ঐতিহাসিক উপাদান প্রচুর। তারকার বন্ধন, লখিন্দরের বাসগৃহ র হাস্য কৌতুক, চাঁদের বানিজ্য যাত্রা , নানা দেশ ও নদীর বিবরণ , নানা স্বর্গের বিবরণ , পল্লীর মানুষের সুখ দুঃখ সামাজিক রীতনীতিতে নারায়ান দেবের
কাব্য পরিপূর্ণ। বক্রোক্তি , কৌতুক রস
তির্যকতা সৃষ্টিতে কবির দক্ষতা অপরিসীম। তাঁর কাব্যে অশ্লীলতা মাঝে মাঝে দেখা যায়, তবে তৎকালীন যুগ
পরিবেশ ও জীবন চেতনার বিচারে দোষা
বহ মনে হয় না।
 
   পরিশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, চরিত্র রুপায়ানে , কাহিনী
গ্রন্থনে , জীবন রসের বৈচিত্রে নারায়ান
দেবের  পদ্মাপুরান উৎকর্ষ কাব্যের সঙ্গে
তুলনীয় । তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে  সপ্তদশ
শতাব্দীর কবি ক্ষেমানন্দ ব্যাস বাল্মীকির
সঙ্গে সশ্রদ্ধ চিত্তে তাকে স্মরণ করেছেন...
   " ব্যাস বাল্মীক কবি নারায়ান তত্ত্ব জানি
     তোমাকে সেবিয়া হইলা কবি " ******************************



কৃত্তিবাসের রামায়ণ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। some details of kirtibasi Ramayana.

 'কৃত্তিবাসী রামায়ণ' সম্পর্কে         সংক্ষিপ্ত আলোচনা

 পৃথিবীর চারটি মহাকাব্যের মধ্যে একটি হল 'রামায়ণ' , যেটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। রামায়ণের প্রভাব সুদূর প্রসারী। বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণ সাত কান্ডে বিভক্ত। বিভিন্ন সাহিত্যিক বিভিন্ন ভাবে 'রামায়ণ ' অনুবাদ করেছেন।
  কবি কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণ
বাঙালি জীবনের উপযোগী করে
পরিবেশন করেন। ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে
শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ' কীর্তিবাস রামায়ণ ' বলে প্রকাশিত হয়। মহাভারতের কথা তথা রামের কথা
গ্ৰামে-গঞ্জে প্রচার করার জন্য তিনি গানের আকারে তা লিপিবদ্ধ করেন। কৃত্তিবাস তার রামায়ণ কে 'লাচাড়ি ' ছন্দের পুরাণ বলেছেন।
 'লাচাড়ি ' হল ছন্দ, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশন করা।
কৃত্তিবাসের ' শ্রীরাম পাঁচালি ' কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা বিভিন্ন পুথি পাঠ করলে বোঝা যায়। তাঁর আত্মবিবরনী থেকে জানা যায় বারো বছর বয়সে শুক্রবারে ' বড় গঙ্গা ' অর্থাৎ পদ্মা 
পার হয়ে গুরুর গৃহে শিক্ষালাভ
করতে গিয়েছিলেন ---  
  ' এগারো নিবড়ে যখন বারোতে প্রবেশ। 
হেন কালে পড়িতে গেলাম উত্তর দেশ।। 
বৃহস্পতিবার ঊষা পোহালেই শুক্রবার। 
পাঠের নিমিত্ত গেলাম বড় গঙ্গা পার।। , 

বিভিন্ন পুথিতে এই প্রসঙ্গ যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে তার দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি--
১) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭১৭ নং
পুথিতে ---                                               
  'ছোটরা বন্দো বড়রা বন্দো বড় গঙ্গার পার। 
যথা তথা করিয়া বেড়ান বিদ্যার উদ্ধার।।,
নলিনী ভট্টশালী কতৃক প্রকাশিত পুঁথিতে -
 ' বারান্তর উত্তরে গেলাম বড়গঙ্গা পার । 
তথায় করিনু আমি বিদ্যার উদ্ধার।। '
      কবি কৃত্তিবাস ' শ্রীরাম পাঁচালী ' জনসাধারণের শিক্ষার উদ্দেশ্যে রাজার আদেশে রচনা করেছেন। 
কৃত্তিবাস মূলত বাল্মীকি রামায়ণ কে অনুসরণ করেছেন । তাছাড়াও
তিনি অন্যান্য গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে কৃত্তিবাসের 
স্বীকারোক্তি হল ---
১) 'নাহিক এসব কথা বাল্মীকি রচনে।বিস্তারিচ লিখিত অদ্ভুত রামায়ণে।। '
২) 'এসব গাহিল গীত জৈমিনি ভারতে।
 সম্প্রতি যে গাই তাহা বাল্মীকির মতে।।
কবি সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাই দেখা যায় কবি অধ্যাত্ম রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, পদ্মপুরাণ, মার্কন্ডেয়পুরান, স্কন্দপুরাণ, দেবী ভাগবত , জৈমিনি ভারত, কালিকাপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ অনুসরণ করেছেন। 

কৃত্তিবাসের কবিত্ব

কৃত্তিবাস তাঁর স্বভাবসুলভ দৃষ্টিতে বাঙালি গ্ৰাম্য জীবনের ছবিকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি পুরাণকে গ্রহণ ও গ্রাস করে বাঙালির স্বভাবসুলভ দৃষ্টি অনুযায়ী নতুন পথের অনুসন্ধিৎসু
যাত্রী হয়েছেন। গল্পরসের মধ্যে যেমন এনেছেন নাটকীয়তা তেমনই আবার করুনরসের কাহিনীতে হাস্যরসকে স্বাভাবিক ভাবে প্রবাহিত করেছেন। করুনরসের বর্ণনায় কৃত্তিবাস অসাধারণ প্রতিভার কবি। এই
করুনরস রামের বনবাস থেকে সীতার পাতাল প্রবেশ পর্যন্ত পাঠককে অশ্রুসিক্ত করেছে --
 'সীতা সীতা বলি রাম ডাকেন বিস্তর। 
সীতা নাহি রামের তরে কে দিবে উত্তর।। 
একদৃষ্টে চাহেন রাম সোনার সীতার মুখ। 
উত্তর না পাইয়া রামের অধিক বাড়ে দুখ।।, 
 করুনরস ছাড়াও কবি হাস্যরসকে
সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা
পাঠককে স্বাভাবিক ভাবেই আকর্ষণ করে। যেমন ----

 'দশমুখ মেলিয়া রাবণ রাজা হাসে। 
 কেতকী কুসুম যেন ফোটে ভাদ্রমাসে।।, 
কৃত্তিবাস চরিত্র গুলি বাঙালির
মতো গড়ে তুলেছেন, তাই মহাকাব্যের চরিত্র গুলির মতো
ওজস্বীতা নেই। তিনি রামকে গড়ে তুলেছেন এক প্রেমের দেবতা হিসেবে। যেখানে বাল্মীকি রামায়ণে
রামকে এক ক্ষত্রিয় বীর পুরুষ হিসাবে দেখানো আছে। আর অন্য দিকে কৃত্তিবাসের রাম সীতার দুঃখে কেঁদে ফেলেন। লক্ষনকে গড়ে তুলেছেন এক বাঙালি ভাই
হিসাবে। আর সীতা এক বাঙালি
গৃহবধূ , যে তার স্বামীকে না দেখতে পেয়ে প্রায়ই কাঁদেন। সব
মিলিয়ে বাঙালি দাদা, ভাই ও বৌদির সুন্দর ছবি বাঙালির
মতোই ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালি
জীবনের হাসি- কান্না, সুখ- দুখ
কৃত্তিবাসী রামায়ণে লুকিয়ে আছে।








বাঙালিদের জানা দরকার। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন।

                    বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ

বাংলা সাহিত্যের তিন যুগের সময়সীমা মোটামুটি এইভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে --
১) আদিযুগ (৯০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০০খ্রিষ্টাব্দ) 
২) মধ্যযুগ(১২০১খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০০খ্রিষ্টাব্দ) 
৩) আধুনিক যুগ (১৮০১খ্রিষ্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত) 

           ১) বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের নিদর্শন

বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের একমাত্র নিদর্শন 'চর্যাপদ '। এতে  মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া পন্থিদের 
ধর্ম পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। এই ' চর্যাপদ ' এর  ভাষার
অসমীয়া ও উড়িয়া ভাষার অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়। চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা তা সুনীতি কুমার
চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'Origin and Development
of the Bengali language' গ্রন্থে বিভিন্ন 
ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়েছেন। 

    ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে  চর্যাপদের পুথি আবিষ্কার করেন এবং
১৩২৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশ
করেন। এই গ্রন্থে চব্বিশ জন কবির নাম পাওয়া যায়।  তাদের মধ্যে কয়েকজন কবির নাম হল, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, সরহপাদ, লুইপাদ, শবরপাদ
প্রভৃতি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ৪৬ টি সম্পূর্ণ পদ এবং একটি পদের  অংশ পেয়েছিলেন। মাঝের কয়েকটি পাতা পান নি। 
     'চর্যা' কথার অর্থ হল 'যা আচরণীয়'। তাই হল 
'চর্যাপদ'। সাধকদের ভজন সংক্রান্ত তত্ত্বগ্ৰন্থ হল চর্যাপদ। সিদ্ধাচার্যরা  তাদের গূঢ় রহস্যময় গোপন
তত্ত্বকথা রুপকের আড়ালে আভাসে ইঙ্গিতে ব্যক্ত
করেছেন। চর্যাপদে গুরু বাদের প্রভাব বিশেষ ভাবে
লক্ষ্য করা যায়। 
   চর্যাপদে তদানীন্তন বাংলাদেশের ভৌগোলিক প্রকৃতি, জল- হাওয়া, নদ- নদী প্রভৃতি স্থান পেয়েছে। তাই চর্যাপদ থেকে যেমন বাংলা ভাষার আদি রুপ
জানা যায়, তেমনি তৎকালীন বাংলার সমাজ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। 

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের অনুবাদ মূলক এবং মৌলিক গ্রন্থ গুলির নাম।

      বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর    বীরসিংহের সিংহ শিশু বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা গদ্যের জনক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ ...